বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চা এবং নতুন প্রজন্ম

29/08/2009 20:55

 

মাসুদা ভাট্টি
 

এই যে ব্রিটেনের দুষ্প্রাপ্য রোদের গ্রীষ্ম, মানুষ যখন ছুটছে ছুটি কাটাতে এদেশে-সেদেশে নিদেন ব্রিটেনেরই কোনও সমুদ্র সৈকতে তখন কয়েকজন সাহিত্য-প্রেমী, বাংলা ভাষা-প্রেমী মিলে আয়োজন করছেন কবিতা উৎসব। কী প্রয়োজন ছিল এসবের? এর চেয়ে তো ভালো ছিল বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন ধুম-ধারাক্কা ধরনের শিল্পী-নাচিয়ে এনে একটা জমজমাট অনুষ্ঠান আয়োজন করা, যার টিকিট বিক্রি থেকে আয়োজকরা অন্ততপক্ষে ছ’মাসের জীবন চালানোর রসদ জোগাড় করতে পারতেন। কিংবা তার চেয়েও ভালো হতো, ঘরের খেয়ে বনের মোষ না তাড়িয়ে এই ছুটিটা নিশ্চিন্তে উপভোগ করাটা। কিন্তু সেরকম কিছুই না করে তারা কেন একটি অলাভজনক কবিতা উৎসবের আয়োজন করলেন? কেনই বা তারা দীর্ঘ মাসাধিক সময় খরচ করে, উল্লেখযোগ্য অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে এই কবিতা উৎসব করতে যাচ্ছেন? আসলে এই প্রশ্নটির উত্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে “বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চা এবং নতুন প্রজন্ম” শীর্ষক নিবন্ধের মূল বক্তব্য।

মানুষের ইতিহাস এবং সাহিত্য চর্চা ঠিক একই পায়ে হেঁটে আজকে যেখানে মানুষের অবস্থান ঠিক সেখানেই সাহিত্য চর্চারও অবস্থান। সেই গুহাবাস যুগে মানুষ তার ভেতরকার সৃষ্টিশীলতাকে ফুটিয়ে তুলেছিল গুহাগাত্রে ছবি এঁকে। তারপর মানুষ ক্রমশ: এগিয়েছে আজকের দিকে, তার সৃষ্টিশীলতার প্রকাশও এগিয়েছে একই গতিতে। তাই একথা জোর দিয়েই বলবো যে, বাংলাদেশেও যে কারণে একজন মানুষ সাহিত্য চর্চা করেন ঠিক একই কারণে প্রবাসে তথা এই বিলেতেও একজন বাঙালি সাহিত্য চর্চা করেন। মনের তাগিদে সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটানোর এই প্রচেষ্টা মানুষের শাশ্বত এবং প্রকৃতিদত্ত; এর বাইরে অন্য কোনও কারণ নেই, থাকতে পারে না।তবে প্রশ্ন হলো, সাহিত্য চর্চাকে জীবন ও জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে নেয়াটা কতোখানি সম্ভব বা তা আদৌ সম্ভব কি না? আজ ইংরেজিসহ বিশ্বের প্রধান কয়েকটি ভাষার লেখককুল শুধুমাত্র লিখেই জীবিকা ধারণ করেন। এক্ষেত্রে অনেক ভাষার লেখককেই জীবন ধারণের জন্য লেখালেখির বাইরে কিছু না কিছু করতে হয়, বা করে থাকেন। এমনকি বাংলাদেশেও হাতে গোনা দু’একজন ছাড়া প্রত্যেক লেখকই লেখালেখির বাইরে জীবন ধারণের জন্য কিছু না কিছু করে থাকেন। তাতে কি তাদের সৃষ্টিশীলতা কিংবা যা লেখেন তার শিল্পগুণ কিছুমাত্র কমে? আমি বিশ্বাস করি না। পূর্ণ সময়ের লেখক ও খণ্ডকালীন লেখক বলতে আসলে কিছু নেই, একজন মানুষ তার ভেতরকার তাগিদে যাই-ই কিছু কলমের ডগা দিয়ে খাতায় ফুটিয়ে তোলেন, তাই-ই শিল্প, এর মান নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন কিন্তু তার এই তাগিদ কিংবা তা প্রকাশ করার তাড়না নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনওই অবকাশ নেই। একথাগুলি এ জন্যই বলছি যে, এই প্রবাসে যখন প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যায়ন হয় অর্থের নিক্তিতে, জীবনের অপর নাম যেখানে ছুটোছুটি সেখানে একজন মানুষ কেন লেখেন, সেই প্রশ্নের উত্তরটা খোঁজার জন্য।
আজকে এখানে যারা উপস্থিত আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই কিছু না কিছু লেখেন। কেউ কবিতা বা ছড়া, কেউ গল্প, কেউ উপন্যাস, কেউ বা প্রবন্ধ। একথা মেনে এবং জেনেই তারা লেখেন যে, এগুলো হয়তো কোনও দিনই কোথাও ছাপা হবে না কিংবা ছাপা হলেও তা হয়তো একসময় পুরনো কাগজ হয় হারিয়ে যাবে, কিন্তু তাতে কি? লেখার আনন্দেই আমরা লিখি, তাই নয় কি? সময়ের ক্লান্তি, কর্মক্ষেত্রের গ্লানি, সংসারের হাজারো ঝামেলা সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে যায় এক লাইন কবিতার কাছে, এক প্যারা ছোট গল্পের কাছে কিংবা একটি ছোট্ট উপন্যাসের কাছে। এই ব্রিটেনে দীর্ঘ দিন যাবত বসবাস করছেন একুশের গানের অমর গীতিকার আবদুল গফফার চৌধুরী। এখন তিনি পৌঁছেছেন পেনশনের বয়সে কিন্তু তিনি যখন এখানে এসেছিলেন তখন তিনি যুবক ছিলেন, ইচ্ছে করলেই লেখালেখির এই পথ ছেড়ে দিয়ে তিনি যে কোনও ব্যবসা করতে পারতেন, পারতেন কোনও প্রতিষ্ঠানে একটি চাকুরী নিয়ে নিশ্চিত জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তা করেননি, তিনি হেঁটেছেন লেখালেখির ভয়ঙ্কর এক অনিশ্চিত পথে। প্রতিদিনকার খবরের কাগজে তিনি কলাম লিখেছেন, চেষ্টা করেছেন অর্থ ধার করে কাগজ বের করতে আর এর জন্য তিনি কম হেনস্থা হননি, জীবনের কাছে বার বার তাকে হোঁচট খেতে হয়েছে, অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, এমনকি হয়তো একটি রাতও তিনি অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে ঘুমোতেও যেতে পারেননি। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি কি পেয়েছেন? হয়তো রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়েছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলার জন্য তিনি সোল এজেন্সি অর্জন করেছেন এবং সর্বোপরি বাংলা ভাষার একজন লেখক হিসেবে তার নাম প্রত্যেককেই উচ্চারণ করতে হবে কিন্তু তিনিতো এটা না করলেও পারতেন? আমি নিশ্চিত যে, শুধুমাত্র খ্যাতির জন্য মানুষ জীবনের এতো বড় ছাড় দিতে পারে না। এর পেছনে থাকে আরও অনেক বড় কিছু, সেটা হয়তো আর কিছুই নয়, মানুষের অন্তরের তাড়না, দেশ ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং সেই সঙ্গে লেখার প্রতি প্রতিশ্রুতি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাই বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের একজন আইকন। আমরা তাকে কেন্দ্র করেই এখানকার সাহিত্য চর্চা এবং নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আলোচনা শুরু করতে পারি, বিস্তারও ঘটাতে পারি এবং তাকে দিয়েই শেষ করতে পারি।
এখানে একজন লেখক যখন একটি কবিতা কিংবা ছোটগল্প বা প্রবন্ধ লেখেন তখন তা ছাপানোর জন্য প্রথমেই পাঠান স্থানীয় বাংলা পত্রিকাগুলোতে। সম্পাদকের কাঁচির ভেতর দিয়ে যখন তা মুদ্রিত হয়ে পাঠকের সামনে আসে তখন তা একজন লেখককে যে কতোখানি ভালোলাগায় অভিভূত করে তা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করার যোগ্যতা কিন্তু সেই লেখক রাখেন কিনা সন্দেহ। কারণ এই অনুভূতি শুধুমাত্র উপলব্ধি করা যায়, তাকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা আসলেই সম্ভব নয়। এই আনন্দ অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব নয় বলেই একজন সফল ব্যবসায়ী, একজন উচ্চ বেতনের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একজন সাধারণ গৃহিনী পর্যন্ত সকল কর্মব্যস্ততার পরও খাতা-কমল ধরেন, কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেন। আর তাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসেন একেকজন লেখক, আগেই বলেছি সবাই হয়তো খুব বড় লেখক হন না, সবার লেখার সাহিত্য মানও ঠিক যোগ্যতার মাপ কাঠিতে টেকে না, কিন্তু তাই বলে কারো প্রচেষ্টাকেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
আজ এই ব্রিটেন থেকে লিখে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে সুনাম অর্জন করেছেন এমন অনেকেই আছেন। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা এই প্রবাসী বাঙালিদের ভেতর থেকেই একজন ঝুম্পা লাহিড়ী কিংবা খালেদ হোসেইনিকে পাবো কিন্তু তার আগে বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চার বর্তমান অবস্থাটা জেনে নেওয়া যাক। এখানে একটি কথা জোর দিয়েই বলবো যে, এখানে সাহিত্য চর্চাটা খুব বিক্ষিপ্ত।তবে এটাও ঠিক যে, আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশেও যেখানে সাহিত্য চর্চাটা বিক্ষিপ্ত, একজন পুরোটাই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সীমাবদ্ধ সেখানে বিলেতের বাঙালিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। একটু ব্যাখ্যা করছি বিষয়টা। বাংলাদেশে আজকাল লেখক তৈরি করে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। এর মধ্যে বিশেষ একটি পত্রিকা আবার তাদের গৃহপালিত লেখক ছাড়া কাউকে লেখকের মর্যাদাই দিতে চায় না। তাদের সাহিত্য পাতায় যারা লেখেন তাদের বইই পুরস্কৃত হয় এবং তারা লেখকের মর্যাদায় ভূষিত হন। প্রতি বছর ঘটা করে কোনও কর্পোরেটের স্পন্সরশীপে জমজমাট আনুষ্ঠানিকতায় এই লেখকদের পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। আর বলাই বাহুল্য যে, এতে প্রতিভার বিকাশ না ঘটে, অপমৃত্যুই ঘটে বেশি। এখানে উপস্থিত যারা আছেন তাদের মধ্যে যারা গল্প-উপন্যাস-কবিতার পাঠক তাদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে, বুকে হাত রেখে বলুন তো গত কয়েক বছরে আপনারা এমন কোনও বাংলা উপন্যাস পড়েছেন কি যা বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী আসন দখল করতে পারে বলে আপনাদের মনে হয়েছে? আমি নিজে একজন লেখক, আমার নিজেরও বেশ কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, তারপরও আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি যে, না এমন কোনও উপন্যাস আমি অন্তত পড়িনি যাকে আমি ধ্রুপদী আসনে বসাতে পারি। অবশ্যই এখানে পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত উপন্যাসের কথা আমি বলছি না, আমি বলছি বাংলাদেশের লেখক এবং তাদের লেখার কথা।
তার মানে কি ভালো উপন্যাস লেখা হচ্ছে না? আমি এটাও মানতে নারাজ যে, ভালো উপন্যাস কেউ লিখছেন না, কিংবা লিখতে পারেন না। আশি পাতায় উপন্যাসের ব্যাপ্তি বেঁধে দেওয়া হলে, ছোটগল্প আর কবিতার বই বিক্রি হয় না বলে প্রকাশকরা ছাপাতে আগ্রহী না হলে সাহিত্য চর্চার অবনতি ঘটাটাই স্বাভাবিক। আর সেই সঙ্গে যদি লেখককে তার রাজনীতি কিংবা ব্যক্তিগত অবস্থান দিয়ে বিচার করাটাই কালচারে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে সাহিত্য চর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ না করে উপায় থাকে কি? তাই শুধু এই বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা নয়, আমি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়েই আসলে যার পর নাই শঙ্কিত। কেন শঙ্কিত সে কথা আস্তে-ধীরে বলি, তার আগে বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চার ভেতর-বাহির নিয়ে কিছু কথা বলে নিই।
আগেই বলেছি যে, সাহিত্য চর্চার খাতটি মূলত: অলাভজনক, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বরং অর্থ ব্যয়ের কারণ হয়ে থাকে। সময়ের অপচয়তো বটেই। কিন্তু তারপরও মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম বলেই মানুষ সাহিত্য চর্চা করে থাকে। সাহিত্য চর্চা একটি চলমান বিষয়, নানা সময়ে এর দিক এবং প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন এক সময় কবি-লেখকগণ একসঙ্গে বসে নিজেদের লেখা পড়তেন এবং তা প্রকাশের আগে একে অপরের সমালোচনার মাধ্যমে লেখাকে জারিত করে তারপর তা প্রকাশ করতেন। এখনও যে এরকমটি ঘটে না তা নয়, এখন লেখকরা নানা শিবিরে বিভক্ত কিন্তু তারপরও একেকটি গ্রুপ নিজেদের মধ্যে তাদের লেখা নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই আলোচনায় বসেন, তবে একথাও ঠিক যে, সেখানে সমালোচনার চেয়ে পিঠ চাপড়ানিই বেশি হয়ে থাকে। তারপরও এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয় যে পথটি বহুল ব্যবহৃত তাহলো, পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত লেখা এবং তা নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা ও চিঠি বা ই-মেইলে পাওয়া পাঠকের সমালোচনা। ব্রিটেনের বাংলা পত্রপত্রিকাতো বটেই, বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলি খুললেও আজ বিলেত প্রবাসী অনেকেরই লেখা পাওয়া যায়। আর তৃতীয় যে মাধ্যমটি আজ বাংলাদেশের মূলধারায় সাহিত্য চর্চার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি তাহলো একুশের বইমেলা। আজকাল শুধু প্রবাসী লেখকরাই নন, অনেক সচেতন প্রবাসী পরিবার ফেব্রুয়ারি মাসকে দেশে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বেছে নেন কারণ এই মাসে বাংলাদেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে বই মেলা নিয়ে।এই বই মেলাকে কেন্দ্র করে যদি প্রতি বছর হাজার পাঁচেক পুস্তক প্রকাশিত হয়ে থাকে তাহলে তার মধ্যে পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থের লেখক প্রবাসী বাঙালি লেখক এবং তার মধ্যে নিঃসন্দেহে বিলেত প্রবাসী লেখকরা এগিয়ে আছেন সংখ্যার দিক থেকে।
একটি মজার বিষয় আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি না করে পারছি না। আজকাল দেশে প্রবাসী লেখকদের বেশ কদর, কারণ কিছু প্রকাশক এই প্রবাসী লেখকদের কাছ থেকে সাহিত্য চর্চার হাদিয়া বেশ চড়া হারেই আদায় করে থাকেন। এমনিতেই বাংলা ভাষায় লিখে অর্থ উপার্জন হিমালয় ডিঙানোর মতোই দুরূহ তার ওপর যদি আবার অর্থ দিয়ে বই প্রকাশ করতে হয় তাহলে প্রবাসী লেখকের সম্মানী প্রাপ্তিটা বোধ হয় অধরাই থেকে যাবে। বিষয়টি এখানে উপস্থিত লেখকদের সকলকেই ভেবে দেখার অনূর্ধ্ব জানাচ্ছি। যাই-ই হোক, দেশে যেমন ঈদ সংখ্যায় কে ক’টা উপন্যাস লিখলেন, আর বই মেলায় কার ক’টা বই বেরুলো তা দিয়ে লেখকের মান বিচার হয় তেমনই বই প্রকাশের আর লেখা প্রকাশের দিক দিয়ে বিচার করলে বিলেতে বাংলা সাহিত্য চর্চা ভালোই হয়। আমি সাহিত্য চর্চার মান নিয়ে কিছু বলছি না, তা নিয়ে অন্য কোনও সময়, অন্য কোনও খানে কথা বলা যাবে।
এখন নতুন প্রজন্ম নিয়ে কিছু বলে এই নিবন্ধের ইতি টানতে চাই। বলা হয়েছিল যে, কম্পিউটার মানুষের বই পাঠের অভ্যাস পরিবর্তন করে দেবে এবং পুস্তক ব্যবসা লাটে উঠবে। কিন্তু তা হয়নি, এমনকি সিনেমা-টেলিভিশনের মতো শক্তিশালী মাধ্যমও পারেনি বই পাঠের জনপ্রিয়তা কমাতে। এটা প্রমাণিত হয় এই ব্রিটেনে একেকটি বইয়ে ৫-৭ মিলিয়ন কপি বিক্রি হওয়ার ঘটনা থেকেই। কিন্তু বাংলাদেশ এবং বাংলা সাহিত্যের বেলায় এর সত্যতা খানিকটা পাওয়া যায়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন যদি বাঙালি মধ্যবিত্তের বই পাঠের অভ্যাসে চিড় ধরিয়ে থাকে তাহলে কম্পিউটার নিঃসন্দেহে বাঙালি তরুণ প্রজন্মকে বই পড়া থেকে দূরে সরিয়েছে খানিকটা হলেও। তবে একথাও সত্য যে, বাংলাদেশে বাংলা মাধ্যমে পড়া তরুণ প্রজন্ম এখনও বই পড়ে, বই কেনে এবং তারাই এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ। অপরদিকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ডিজুস প্রজন্ম আধো বাংলা আধো ইংরেজিতে কথা বলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে কর্পোরেট বাণিজ্যে চাকুরী নিয়ে কাড়ি কাড়ি অর্থোপার্জন করে ঠিকই কিন্তু তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে সাহিত্যের অবস্থান নিতান্তই শূন্যের কোঠায়। ধরে নিচ্ছি তারা তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের বাংলা উপন্যাস পড়তে পারে না কিন্তু তাই বলে তারা কিন্তু হালের অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতী রয় কিংবা খালেদ হোসেইনিও যে খুব একটা পড়ে তা কিন্তু নয়। একই কথা প্রযোজ্য বিলেতের তরুণ বাঙালি প্রজন্মের ক্ষেত্রেও। তারা নিজেদেরকে ব্রিটিশ বলে ভাবে ঠিকই, কিন্তু ক’জন বাঙালি তরুণ মার্গারেট এ্যাটউড বা মার্টিন এ্যামিস পড়ে তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। কেউ কেউ হয়তো পড়ে ঠিকই কিন্তু তাদের হাতে গুণে বের করা যায়। তার মানে এটাই যে, বাঙালি তরুণ প্রজন্মের কাছে শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, বিশ্ব সাহিত্যও উপেক্ষিত। তারা নিজেদের পরিচিতি নিয়ে এক মহা বিপাকে পড়েছে, তারা না পারছে মেইন স্ট্রীমে নিজেদের অবস্থান করে নিতে, না পারছে হুমায়ূন আহমেদ বা আনিসুল হকের রচনার স্বাদ নিতে। তারা বেড়ে উঠছে সাহিত্য চর্চাহীন এক উদ্ভট শূন্যতায়। এতে তাদের দোষ কতোখানি আর কতোখানি তারা পরিস্থিতির শিকার তা সত্যিই গবেষণার দাবি রাখে। এই স্বল্প পরিসরে আমি তার কারণ খুঁজতে যাবো না, সে জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।
তবে আগেই বলেছি যে, এই শূন্যতার ভেতর থেকেও হয়তো আমরা একদিন পেয়ে যাবো একজন ঝুম্পা লাহিড়ী কিংবা খালেদ হোসেইনিকে। কেউ হয়তো বলবেন যে, মণিকা আলী আছেন আমাদের। হ্যাঁ তিনি আছেন ঠিকই, তাকে নিয়ে আমরা গর্বিতও, ব্রিটিশ মূলধারায় আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারি কিন্তু নিজের কাছে সত্য গোপন করার নামতো আত্মপ্রবঞ্চনা, তাই না? আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এই যে, প্রবাসে বসে বাংলায় লিখছি, একটি দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করি এই লেখালেখির পেছনে, অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয় এই লেখার জন্য, কেন করছি এসব?হয়তো এই সময়টা অন্য কিছুর পেছনে দিলে এই প্রবাস জীবনে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য যোগ করা যেতো। এসব চিন্তা যখন মনের ভেতর আসে তখন নিজেকে কষে এক ধমক দিই, বুকের মাঝে চিনচিনে এক গর্ব নিয়ে বলি, “আমি লেখক, আমি লিখি, আমি বাংলা ভাষায় লিখি, আর কেউ না হোক, আমি নিজের জন্য লিখি, এই গ্রীষ্মে স্পেইনের উজ্জ্বল সূর্য যাকে ইচ্ছে তাকে আনন্দ দিক, আমাকে আমার গল্পের একটি শব্দ তার ঢের বেশি আনন্দ দেয়। আমি সেই আনন্দে আলোকিত”। এখানে উপস্থিত যারা লেখেন, তারা কি এরকম করেই ভাবেন না? আমি নিশ্চিত যে, এরকমটাই ভাবেন।