বাংরেজি’র উৎপাত - কাদের মাহমুদ

 ১.
মানুষের কোন ভাষাই অক্ষয় নয়, অথবা দুর্ভেদ্য প্রাকারও নয়। ভাষার যেমন উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে তেমনি এর অধঃপতন ও বিলুপ্তি-ও হয়। সংস্কৃত একদা পুরোহিতের বেদবাক্য উচ্চারণের ভাষা তো ছিলোই, আরো ছিলো মহাকাব্যের অমোঘ ভাষা। আজ আর সে মহাকাব্য রচিত হয় না, সংস্কৃতের সে চর্চাও নেই। সংস্কৃতের মতো লাটিনও ছিলো ধ্রুপদ সাহিত্য ও ধর্মের ভাষা। অথচ এ দুটি প্রবল ভাষা কখনোই সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে নি। সে কারণে, দুটি ভাষাই আজ মৃত।
প্রশ্ন, মানুষের ভাষা কখন শুরু হয়?
সাংকেতিক (দৈহিক অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে), মৌখিক, ও লেখ্য Ñএই তিন প্রধান প্রকারে মানুষের ভাষা এসেছে। প্রথম দুটো আদি প্রকরণের প্রমাণ মানুষের কাছে নেই; ধারণ করা যায় নি বলে এরা হারিয়ে গেছে। কত বছর আগে মানুষ ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেছিলো, তা-ও এখনো ভাষাবিদ ও নৃতাত্ত্বিকদের অনুমানের উপর নির্ভরশীল। ৫ লাখ থেকে ৫০ হাজার বছর। আদি বাসভূমি আফ্রিকাতে গিয়ে, সেখানে আদি মানুষের ফসিল কংকাল বিশ্লেষণ ক’রেও উৎপত্তির সঠিক সময় ঠাহর করা সম্ভব হচ্ছে না।
 তবে কী ভাবে ভাষার উদ্ভব হয়?
একটি বৈজ্ঞানিক একটি গল্প¡  আছে। মানবের উষাকালে ইউরোপে দুটি গোত্র ছিলো। একটি গোত্র ছিলো দৈহিকভাবে বলশালী, কর্মক্ষম, দুঃসাহসী ও দুর্ধর্ষ; -বরফের মতো ঠান্ডা ও ঝড়ো এবং রুদ্র প্রকৃতির সাথে যুঝে টিকে থাকার জন্যে দরকারি দৈহিক গুণাবালী তাদের ছিলো। একই সময় আর একটি গোত্র ছিলো, যারা দৈহিক বল ও বৈভবে, তুলনামূলক ভাবে, দুর্বল ছিলো। কালে দেখা গেলো, বলশালী গোত্রটি এক সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ, এদের চেয়ে দুর্বল গোত্রটি টিকে যায়। কী করে? বিশ্লেষণ ক’রে দেখা যায়, দুর্বল দলটির টিকে থাকার কারণ, তাদের একটি ভাষা ছিলো। এই ভাষায় তারা নিজেরই কেবল কথা বলতো না, বেঁচে থাকার সে সব বুদ্ধি আর কৌশল তারা উদ্ভাবন করেছিলো, সেগুলো তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে যেতে পারতো। এই ভাবে, প্রাণে বেঁচে থাকার বিদ্যা লাভ ও বর্ধন করতে পেরে, গোত্রটি বংশ বৃদ্ধি করে দীর্ঘায়ু হতে পেরেছিলো।
কী করে মানুষের ভাষা শুরু হয়, তা সন্ধান করার ব্যাপারে নানা প্রবাদ আছে। ফেরাউন পিসামটিক দুটো শিশুকে বোবা-কালা লোকের হাতে দিয়ে লালন করান। বহু পরে, তার কাছে এদের হাজির করা হয়। কেবল একটি শিশু যে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছিলো সেটাকে প্রিজিয়ান ভাষার রুটির প্রতিশব্দ মনে করা হয়। তাই মিশরের রাজাও ধরে নেন, মানুষের আদি ভাষা ছিলো, ফ্রিজিয়ান। স্কটল্যান্ডের রাজা ৫ম জেমসও এমন একটি পরীক্ষা করে দেখতে পান, তার শিশুরা হিব্র“ ভাষা বলছে। মধ্যযুগের সম্রাট ২য় ফ্রেডারিক এবং আকবার বাদশাহও এমন নীরিক্ষা করেন। তবে এ ক্ষেত্রে শিশুরা কথাই বলে নি। 
কেবল প্রমাণ আছে যে, মাত্র হাজার ৯ বছর আগে, কৃষিজীবি মানুষ লিখতে শুরু করেছিলো সাংকেতিক ভাষায়। এ দিয়ে তারা ফসল ও সম্পত্তির হিসেব রাখতো।
মনে হয়, প্রাণী হিসেবে মানুষের বিকাশের সাথে সাথে, বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে যত চিন্ময় হতে হয়েছে ততই সে বাঙ্গময় হয়ে উঠেছে। আমরা জানি, মানুষের ভাষা ভাব বিনিময়ের বাহন। এই ভাব আবার মুখ্যতঃ দু প্রকারের। ব্যবহারিক ও আবেগিক। যখন প্রাণরক্ষা বা জীবনচর্চায় ভাষাকে ব্যবহার করা হয় তখন সেটা হয় ব্যবহারিক। নিত্যদিনের প্রয়োগিক বা আটপৌড়ে ভাষাও বটে। ভাষার এই ব্যবহারটাই অধিকতরো ও ব্যাপকতরো। মানুষ যখন তার মনের- দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, আশা- হতাশা, স্বপ্ন ও কল্পনা, রাগ-ক্ষোভ, ইর্ষা-ঘৃণা ইত্যাদি প্রকাশ করার জন্যে ভাষাকে ব্যবহার করে, তখন সেটা, আবেগিক।
জীবন রক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষা, তথাÑ শিকার, খাদ্যসংগ্রহ ও উৎপাদনের বিদ্যা এবং তথ্য বিনিময় করার মাধ্যমে হয়তো ভাষার সূচনা হয়। তবে পরে-পরে, যুদ্ধ, অভিযান, আক্রমন, দখল, জয়-পরাজয়, সন্ধি-মৈত্রী, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো কাজে ভাষার প্রয়োজন হয়েছে। পথ প্রদর্শক, দলনেতা, গোত্র প্রধান, রাজা, সেনাপতি, ওঝা ও চিকিৎসককে সাধারণের সাথে ভাব বিনিময়ে ভাষার দরকার হয়েছে। একদিন ক্রেতা ও বিক্রেতাকে মুখের ভাষায় লেন-দেন করতে হয়েছে। একদিন ধ্যানী ও মুনি-ঋষিকেও কথা বলতে হয়েছে। কবি কবিতা আবৃত্তি করেছে, গায়ক গান গেয়ে শুনিয়েছে। সমাজবদ্ধ ও পারিবারিক জীব হিসেবে মানুষের জীবনে প্রীতি-আদর, স্নেহ-মমতা, আদর-যতœ, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা’র ভাষা তো স্বতঃই উৎসারিত হয় । 
এই ভাবে, একটি গোত্রের একটি ভাষা হয়েছে, আবার অন্য গোত্রের মিলনে ও মিশ্রনে অথবা সংঘাতে তাদের ভাষার বদল হয়েছে বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ভাষা হয়ে উঠেছে। কখনো একটি গোত্র বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে তাদের ভাষাটি অক্ষুন্ন বা অনুন্নত থেকে গেছে কিম্বা স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয়েছে; বিজিত গোত্ররা বিজয়ীদের কাছে নিজেদের ভাষা হারিয়েছে। কখনো কয়েকটি ভাষা পাশাপশি গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক কারণে কোন গোত্র বিলুপ্ত হলে, তার ভাষাও হারিয়ে গেছে।
এখন চারটি কথা। এক, ভাষা একটি মানব গোত্রের আত্ম-পতাকা বা আত্ম-পরিমা বলে পরিচিত হয়। তাই কোন ভাষা ক্ষুন্ন হ’লে, গোত্রটি আহত বা পদানত হয়। দুই, ভিন্ন গোত্রের ভাষা শিখে ফেলার মধ্যেও উপকার আছে, দোভাষী ও পর্যটক এর প্রমাণ। তিন, ভিন্ন গোত্র-জাতির সাথে যোগাযোগ ও লেনদেনে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। যেমনÑ পালি ও সংস্কৃত তো আছেই, তারপর আরবী, ফার্সী, ইংরেজি, পর্তুগীজ, উর্দু সহ নানা ভাষার শব্দ আসায় বাংলা আজ বর্ণালী ও জোরদার ভাষা। যেমন, বহু ভাষার শব্দে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে ইংরেজি ভাষা। চার, ভাষা বহতা নদীর মতো, সে আপন নিয়মে চলে।                
২.
আমাদের বাংলা ভাষার বিকাশেও এই স্তরগুলো কোন না কোন ভাবে দেখা দিয়েছে। বাংলা ভাষার উদ্ভব প্রাকৃতে অর্থাৎ মুখের বা কথ্য ভাষায়, সেখানে এটার শিকড় প্রযোগিক প্রকরণে : মানুষ জীবনের তাগিদে নিজেরাই এই ভাষা তৈরি করেছে। আদিতে বৌদ্ধ ধর্মীয় ভাষা, পালির সমর্থন পেলেও, তখনকার হিন্দু শাসক ও তাদের ধর্মের ভাষা, সংস্কৃত যারা চর্চার করতেন, উভয়ের উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় শিকার হয়। সেখানেই বাংলার স্ফুরণ ও লালন হয়। সংস্কৃতভাষীরা বাংলাকে ধিক্কার দিতো ‘‘পাখি’র ভাষা’’ বলে।  তখন না মন্দিরে বা তিথিতে, না রাজদরবারে তার ঠাই ছিলো। তবে কালে কালে বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম জীবনের ছাপ পড়েছে বাংলা ভাষায়।
মুসলিম শাসন আমলে এসে বাংলার রাজদরবারে বাংলার কিছুটা ঠাই হয়। দিল্লীতে ছিলোই না। ফার্সী ছিলো রাজভাষা। তবে বাংলাদেশে তখন সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের কাজে-কর্মে আর সাহিত্যে ও সঙ্গীতে ছিলো বাংলার একান্ত ঠাঁই। বৃটিশ আমলে রাজাভাষা হয় ইরেজি। তরে রক্ষে, এ সময় শিক্ষায়, বাংলার ঠাঁই হয়েছিলো। তখন শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় যাত্রা। প্রথম দিকে, সংস্কৃতকে লিখিত বাংলার উপর জোর ক’রে চাপিয়ে দেয়ার একটা চেষ্টা হয়, তবে তা পাকা হতে পারে নি। একই সময়, শিক্ষিত বাঙালিদের মুখের ভাষায় ইংরেজি শব্দের আতিশয্য ছিলো, তবে এটাও টেকে নি।
১৯ শতকের বাংলা কবি আব্দুল হাকিম (১৬২০-১৯৯০) সংস্কৃত, আরবী ও ফার্সী জানতেন, তবে তখনি সখেদে বলেছিলেন যে, যারা বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও বাংলা ভাষাকে হিংসা করে তাদের জন্মের ঠিকানা তিনি জানেন না।   

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।।
   সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
অখন্ড বাংলাদেশে এর পরেও, সংস্কৃত শিক্ষিতদের মতো, আরবী-ফার্সী শিক্ষিতরাও বাংলাকে নিজস্ব, বিশেষতঃ ধর্মের ভাষা বলে ধরতেন না। একজন হিন্দু প্রথম কোরাণ শরীফ আরবী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। সারা বাংলাদেশেই উচ্চশ্রেণীর মুসলমান বলে কথিত পবিারারগুলোতে আরবী, ফার্সী ও উর্দু চর্চা হতো, বাংলা হতো না। এদের মধ্যে পূর্ববঙ্গে ঢাকার নবাব পরিবার সহ ঢাকার কিছু উর্দুভাষী পরিবার এবং কোলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে বহু পরিবারের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। ফলে, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে, বাংলা মুসলমানের ভাষা কি-না, এ রকম একটা বিতর্ক শিক্ষিত মহলে জোরদার হয়। এই বিতর্ক পাকিস্তান হবার পরেই ঐতিহাসিক রূপ লাভ করে। জিন্নাহ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানান, ঢাকা নবাব বাড়ীর খাজা নাজিমুদ্দিন সেই তালে নাচেন। ১৯৫২ সনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে বিক্ষোভ মিছিলের উপর মুসলিম লীগ সরকারের পুৃলিশ গুলী চালায়। ফলে ঐতিহাসিক রক্তরাঙা শহীদ দিবসের সূচনা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে সাথে, সরকারিভাবে ও প্ররোচনায় নানা দূরভিসন্ধিমূলক প্রচারণা চালানো হয়, যেমন- বাংলা হিন্দুর ভাষা Ñমুসলমানে ভাষা নয়; এতে ইসলাম ধর্ম চর্চা করা য্য় না । কখনো আরবী হরফে বাংলা লেখা, রোমান হরফে বাংলা লেখা, এমন কি বাংলা ভাষা কঠির বলে প্রমাণ করার নামে ‘সোজা’ বাংলাকে ‘স-ও-জ-আ’ লেখার অপচেষ্টা করা হয়। এরা কখনোই স্বীকার করে না যে, পৃথিবীতে যে গুটিকয় ধ্বনিতাত্ত্বিক ভাষা আছে, বাংলা তাদের একটি। বাংলা ভাষার গৌরবকেও তারা অক্লেশে মানে নি। বিশ্বকবি রবীন্দনাথ ঠাকুরকে তারা বর্জন করার ধৃষ্টতা দেখায়।   
১৯৫২ সনের বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধ’রে, ১৯৭১ সনে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত হয়, ১৯৭৩ সনে সর্বপ্রথম বাংলায় সংবিধান রচিত হয়। অবশেষে আশা করা গিয়েছিলো, অচীরে একদিন বাংলাদেশের প্রশাসন, বিচার-আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।
আজ ৩৬ বছর পরে, পরিস্থিতিটি কী?
৩.
আজ বাংলাদেশে সংবিধানের মূল প্রাসঙ্গিক ভাষা ইংরেজি Ñবাংলা নয়। প্রাশসনের ভাষা কতকটা ইংরেজি ও কতকটা বাংলা। আদালতেও তথৈবচ। আর শিক্ষায়? সেখানে চলছে ভয়ঙ্কর অরাজকতা। দেশজুড়ে একাধারে ইংরেজি, আরবী ও বাংলা মাধ্যমে শিশুদের পড়ানো হচ্ছে।
ফলে, বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও, সেখানে এমন শিশুরা আছে যারা বাংলা ভাষায় নিরক্ষর। তারা ইংরেজি জানে, আরবী জানে কিন্তু বাংলা জানে না। আপনারা হয়তো ভাববেন, কি বিচিত্র বাংলাদেশ!
প্রধানতঃ রাজধানী ঢাকার ধনী এলাকা ও বাড়িগুলোতে ইংরেজি পড়ুয়া বটে কিন্তু বাংলায় অশিক্ষিত শিশু, কিশোর, কিশোরী ও তরুণ-তরুণীর দল আছে, যারা তাদের মা-বাবা’র গর্বের ধন। এদের মুখের ভাষা এক বিচিত্র মিশ্রন। অনেকটা যেমন বিলেতে বাঙালি ছেলে-মেয়েরা খানিকটা সিলেটী, খানিকটা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে; যে ভাষা কেবল তারাই ভলো বোঝে। বাংলাদেশে’র ধনীর আদরের দুলাল-দুলালী’দের মুখের মিশ্র ভাষা, যাকে আমি বলি, বাংরেজি: এর কিছুটা বাংলা, অনেকটাই ইংরেজি। এ নিয়ে দেশে আমি লিখেছিও, পরে আরো লেখালেখি হয়েছে। একটি বাংলা পত্রিকা আমার এ বিষয়ক লেখা ছাপাতে অস্বীকার করে; কারণ এই পত্রিকাতেই বাংরেজি’র প্রবল সমর্থন আছে।
ঢাকায় দুটি রেডিও স্টেশন আছে, নামÑ ‘ফুর্তি’ ও ‘রেডিও ওয়ান’। এই দুটিতেই, বিশেষ ক’রে ‘ফুর্তি’তে বাংরেজি’র এ›তার চর্চা হচ্ছ্।ে মর্মান্তিক ব্যাপার হচ্ছে, একুশের বই মেলায় আরো দুয়েকটা কুকীর্তির মতো, ‘রেডিও ফুর্তি’কেও ঠাঁই দেয়া হয়।
টেলিভিশনগুলো প্রবল সংযোগ মাধ্যম বলে, তাদের কুকীর্তির মাত্রা কম নয়। তাদের নাম, তাদের অনুণ্ঠনের নাম যদি ধরেন দেখবেন সেখানে ইংরেজি দাঁত খিচিয়ে আছে। কোন কোন উপস্থাপকের ভাষা নির্ভেজাল বাংরেজি। বাংলাদেশে বসে শুনলে মনে হবে কোন বিদেশি অনুষ্ঠান শুনছেন। অনেক বাংলা নাটকের সংলাপেও, ইংরেজির আবশ্যক ছাড়াও, অহরহ অঢেল অনাবশ্যক অনুপ্রবেশ আছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, বাংলা সংবাদ। এগুলোতে অহরহ বিদেশি তো বটেই, দেশি লোকেরও, মন্তব্য থাকে Ñযা পুরো ইংরেজি ভাষায়, অথচ সাথে বাংলা অনুবাদ থাকে না। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, শ্রমিক নেতা, আমলা, সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকে যখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেন, তখন শুনবেন তাদের ভাষায় কেমন ক’রে ইংরেজির খই ফোটে।
টিভিতে ব্যবহৃত অগণিত ইংরেজি শব্দের মধ্যে, একদিন এক বাঙালি বুদ্ধিজীবি অবলীলায় ‘ওহপড়হংরংঃবহঃ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। যাচাই করে দেখার জন্যে আমি এমএ বিএ পাশ কয়েকজন বাঙালির কাছে শব্দটির অর্থ জানতে চাই। তারা কেউ এর অর্থ বলতে পারে নি। এখন বুঝুন!
তাই প্রশ্ন, যেখানে বেতার ও টেলিভিশন গণ-মাধ্যম Ñসর্ব শ্রেণীর মাধ্যম এবং যেখানে বাংলাদেশের জনগনের শতকরা মাত্র ৪৩.১% ভাগ কেবল সাক্ষর অর্থাৎ শুধু লিখতে পড়তে জানে, সেখানে ইংরেজির এই বাড়াবাড়ির অর্থ কি? দেশের বেশির ভাগ মানুষই যদি বুঝতে না-পারে তবে কা’দের জন্যে এগুলো প্রচার বা চর্চা করা হয়? সহ্য করা হয়?
বাংলাদেশে তেমন নয়, তবে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালি লেখকদের বইপত্রে বেশি করে মিশ্র বাংরেজি দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে তো তাদের হিন্দী রাষ্ট্র ভাষা আছে, আর ইংরেজি আছে আন্তঃরাজ্য মাধ্যম বা কার্যতঃ ২য় রাষ্ট্রভাষা। সেখানকার প্রয়োজন বাংলাদেশ থেকে আত্যন্তিকভাবে ভিন্ন। বাংলাদেশে তার ‘হনুকরণ’ হবে কেন?         
কিছু লোকের বিদেশ যাওয়া বা বিদেশে শিক্ষালাভ বা চাকুরি করার জন্যে ইংরেজি ভালো ভাবে তাদের শেখার সীমিত দরকার তো আছেই। তাই বলে সুপ্রতিষ্ঠিত ও বলিষ্ঠ বাংলা ভাষার উপর ইংরেজি শব্দের উৎপাত চাপানো কেন? তাই প্রশ্ন, সজ্ঞাতে কি অজ্ঞাতে, আজকে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বাঙাালিরা কি বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কোন হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে? 
-০-