তৃতীয়বাংলা কবিতা উৎসব

 

তৃতীয়বাংলা কবিতা উৎসব

 মিলটনরহমান

(প্রাসঙ্গিক কারণে অনেক দিন থেকে তৃতীয়বাংলার কবিতা উৎসব বিষয়ে লিখবো ভেবেছিলাম। লেখাটি আজকের(১৩/০৯/২০০৯) যুগান্তরে ছাপা হয়েছে। পাঠের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে নীচে লিংক ও দেয়া আছে।
--------------------------------------------------------------------------------
আবারো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তৃতীয় বাংলার কবিতা উৎসব। গত বছর লন্ডনে তৃতীয় বাংলার প্রথম কবিতা উৎসবের আয়োজন করে সংহতি সাহিত্য পরিষদ। সংহতির এ উদযোগে স্বস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় বিভিন্ন সাহিত্য, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কবি-সাহিত্যিকগণ। উৎসবে বাংলাদেশ থেকে কবি বেলাল চৌধুরী এবং কবি রফিক আজাদ এসেছিলেন। ২০০৮ সালে উৎসবের সূচনা লগ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঋদ্ধ কবিদের উপস্থিতিতে আনন্দমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হলেও পরিস্থিতি এমন কন্টক শূন্য করে তুলতে উদ্যোক্তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েও কিছু কিছু ব্যক্তি বর্গের উপস্থিতিও দর্শকদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। দেশেই যখন একটি রাজনৈতিক দলে তাদের শক্ত পদচারনায় দলটি নির্বাচনে ব্যপক ভরাডুবির পরও তাদের ছাড়াতে পারছেনা সে স্থানে একটি কঠিন ব্যাপারতো বটেই। কিন্তু উদ্যোক্তাগন শেষ পর্যন্ত কবিতাকে আর মৌলবাদে জড়িয়ে ফেলেননি। সে জন্য তারাই সর্ম্পূণ কৃতিত্বের দাবীদার।

জনগনের এ প্রত্যাশা এবারো দূর্লক্ষ্য নয়। কেমন হবে তৃতীয় বাংলার কবিতা উৎসব? কারা এ আয়োজনে অর্থ যোগাবেন। কি তাদের পরিচয়। এরাকি আসলেই শিল্প-সাহিত্যকে সবসময়ই এভাবে অনুদান দিয়ে এসেছেন বলে সুনাম রয়েছে? কারা আমন্ত্রীত অতিথি হবেন? কারা নিজেরা স্বেচ্ছায় এতে যোগ দেবেন? স্থানীয় কবিগন কারা। যারা কবিতা পড়বেন বা যাদের কবিতার অক্ষর-ভাষায়-চিন্তায় প্রকাশিত হবে গ্রন্থ, তাদের কবিতা বাছাইয়ের জন্য কি কোন নীতি মালা অনুসরণ করা হবে? পুরষ্কার এর বিচারক কারা? এ রকম নানান প্রশ্ন নিয়ে শুরু হয়েছে এবারের আয়োজন। মাঙ্গলিক কোন আচার-অনুষ্ঠানের জন্য বাচ-বিচার আবশ্যকীয়। সে নিয়ম নিশ্চয় অনুসরণ করে সংহতি।

যতদূর মনে পড়ে গত বছর কবিতা উৎসবের প্রাক প্রস্তুতি সভাগুলোতে মৌলিক কিছু বিষয়ে একনিষ্ট থাকার কথা উঠে এসেছিলো আর তাতেই মূল আয়োজক সংগঠণ সচেতন ছিলো।, কিন্তু দূর্জনের ছল একটু পয়োমন্তরই হয় বটে। তাতে করে সংহতি বর্ণচোরদের ঠিক চিহ্নিত করতে পরেনি। প্রবাসে প্রথম বারের মত এত বড় আয়োজন, তাতে কিছুটা বিচ্যুতি হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। যদিও সে বিচ্যুতি নানা বিতর্ক তৈরী করেছে। বিতর্ক তৈরী হওয়াটা বলতে পারি সংহতির জন্য একটি সুরম্য পথও তৈরী করেছে। নিশ্চিত নির্দেশনা দিয়েছে কোন পথে হাঁটতে হবে। কোন পথে হাঁটতে হবে না। এবার শুধু পথ চিনে হাঁটাই বাঞ্চনীয়।

প্রাসঙ্গিক কারণে আমরা মনে করতে পারি বাঙলা সাহিত্যের আধুনিক কবিদের কথা। যে সময়ে পশ্চিমের রিল্কে, ইয়েটস, এলিয়ট-এরা আধুনিক হয়েও আটকে ছিলেন, আদিম ধর্ম, হাস্যকর অতীন্দ্রীয়তা আর যতসব অবিশ্বাসে, সে সময়ে জীবনান্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব এবং সুধীন্দ্রনাথ এসব অবিশ্বাস এবং অতীন্দ্রীয়তাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শামসুর রাহমান আজীবন ছিলেন আপোষহীণ। তাঁর নেত্রীত্বেই একদিন বাংলাদেশে জাতীয় কবিতা পরিষদের শুরু হয়েছিলো। আজ যারা তৃতীয় বাংলার কবি হিসেবে পরিচিত এবং পরিচয় দিচ্ছেন তাঁরাতো ওঁদেরই উত্তরসুরী। আমাদের গভীর ভাবে ভাবিত হবার প্রয়োজন রয়েছে যে, আমরা কবিতায় কি বলতে চাই, কী হবে কবিতার ভাষা-চিন্তা-দর্শন? কেননা কবিতা সব সময় নিজের কাজ করেছে সতর্কতা এবং দ্রুততায়। বায়ান্ন থেকে একাত্তর কী সে কথা বলে না?

কবি টি এস এলিয়টের জন্ম আমেরিকায় হলেও তিনি ব্রিটিশ কবি হিসেবেই পরিচিত। দ্বিতীয় কবিতা উৎসবের প্রাক্কালে তাঁর কথাই মনে পড়ছে। ১৯১৪ সালের আগস্টে আমেরিকা থেকে লন্ডনে দর্শন পড়তে এসেছিলেন, কিন্তু সে সময়ে তাঁর কাছে দর্শন পড়ার চেয়ে মহাযুদ্ধ মুখ্য হয়ে উঠেছিলো। আর তিনি বলেছিলেন, "[My poetry] wouldn't be what it is if I'd been born in England, and it wouldn't be what it is if I'd stayed in America. It's a combination of things. But in its sources, in its emotional springs, it comes from America." লন্ডনে তৃতীয় বাংলার কবিতা উৎসব আমাদের কাছে সে রকম একটি বিষয়। বিশ্বের যেখানেই বাঙালী. বাংলাসাহিত্যানুরাগীগণ ও কবি রয়েছেন সকলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত পতাকা ও পায়রা ওড়াচ্ছেন। আমরা আশা করবো তৃতীয় বাংলার সাহিত্য উৎসবে এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে তারা এবারে যথেষ্ট সর্তকতা অবলম্বন করবেন। বোধকরি সেটা তাদের জন্য কোনো কঠিন কাজ নয়। না হলে যে জনমনে অশান্তির সঙ্গে তাদের প্রতি অনাস্থারও উদ্রেক হবে।

সংহতি কবিতা উৎসবের মাধ্যমে তৃতীয় বাংলার সাহিত্য চর্চার একটি নির্দিষ্ঠ ভূমি চিহ্নিত করতে চলেছে। এবারের উৎসবে কবি আসাদ চৌধুরী ও কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী আসছেন। তাঁদের স্বাগতম জানিয়ে বলতে চাই তাঁদেরো বোধকরি কোথায় আসছেন, কারা তাদের সঙ্গে চেয়ারে বসবেন, কারা তাদের সামনে বসিয়ে কবিতা পড়ে যাবেন তা নিয়েও ভূমিকা রাখার কথা ভাবতে পারেন। অন্তত তাদের চেনা বামুনদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। লন্ডনে বেশ ক’জন অগ্রজ কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক রয়েছেন, যাঁদের তৈরী সড়কে এখন আমরা হাঁটি। তাঁরাও বোধকরি ভাবেন, আসন্ন কবিতা উৎসব নিয়ে। কেননা যতনে লালিত পোষ্যের কোন ক্ষতি তাঁরা চাননা। আমি মনে করি কবিতা উৎসবে নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের চিন্তা কাজে লাগানো সংহতি সাহিত্য পরিষদের সূচনা কর্মের মধ্যেই পড়ে। কেননা সংহতি আজ যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে কবিতা উৎসব আয়োজনের কথা ভাবছে, সেটি স্বতন্ত্র কোন ভূমি নয়। সেটি আমাদের অগ্রজগণের তৈরী। এটা সর্বজনের। (এখানে প্রয়োজন বোধকরি না সর্বজনের সংজ্ঞা কি হবে সে বিষয়ে পূণঃআলোচনার। মনে রাখলে হবে শুধূ এখানে কোন দূর্বৃত্ত এবং দূর্বৃত্তায়নের সুযোগ নেই।) যে কোন কাজ শুদ্ধ হয় পরিপক্ষ হাতের নির্মাণে। আমাদের তো সে হাত রয়েছে। সংহতি কি সে সব হাতের দ্বারস্থ হয়েছে?

১১ অক্টোবরে তৃতীয় বাংলার কবিতা উৎসব। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কবি-সাহিত্যিকগণ সেদিনের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকেই আসবেন। গত বছরও এসেছিলেন অনেকে। প্রবাসে এমন একটি কবিতা উৎসব উত্তর আমেরিকার ’পোবানা সম্মেলন’র মত মিলনোৎসবে পরিণত হবে এমন আশা করা বেশি হবে না। সংহতি সাহিত্য পরিষদে যাঁরা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের নিরন্তর খাটুনি এবং বাংলা কবিতা সাহিত্যের প্রতি তাঁদের লালিত স্বপ্নিল দ্যোতনা একদিন লন্ডনে একটি উর্বর ভূমি তৈরী করবে। সে ভূমি শুধূ বাংলা এবং বাংলা কবিতার কথা বলবে। প্রবাসে কবি এবং কবিতার জন্য এমন ঋদ্ধ আয়োজনের দিকে শুধু বাংলাদেশে নয় পুরো বিশ্বে যাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন সবাই তাকিয়ে আছেন। সবাই মনে করেন এ উৎসব একদিন নিরাপদ জায়গা তৈরী করবে বাংলা সাহিত্যের।

কবিতা উৎসবের দিন হবে কবি-সাহিত্যিক এবং শুদ্ধতম শুভার্থীদের জন্য বিশেষ দিন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে স্বাপদ পায়রা উড়ে যাবার মূহুর্ত গত বছরের মত এবারও তৈরী করবে সুরেলা-সুনীল আবহ। যে সুর শুধু বাংলার আকাশে বাজে। সে সুর এখানে বাজে বলেইতো আমরা দাঁড়িয়ে আছি তৃতীয় বাংলায়। বাংলার আকাশ যেমনি এক তেমনি বাংলা কবিতা উৎসবও বোধকরি হবে এক। এর অন্যথা হবে না বলেই সংহতির সাথে শুদ্ধচারীগণ উৎসব সফলে সহযোগিতা করবেন বলে আশা রাখি।

আজকের(১৩/০৯/২০০৯) যুগান্তরে লেখাটি পড়তে চাইলে এই লিংক এ ক্লিক করুন- Click This Link