কবিতা প্রসংগ - মাসুদ আহমেদ

কবিতার সংগে আমাদের পরিচয় ঘটে মাতৃক্রোড়ে। জন্মলগ্নের নাতিদীর্ঘ সময়ের পরে, তখনো বোধের উন্মেষ ঘটে নি, মাতা এবং সন্নিবেশিত মহিলাবৃন্দ আশ্রয় গ্রহন করেন কবিতাধর্মী বাক্যাবলীর। কবিতাশ্রয়ী এই আলাপন আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় পরবর্তীতে পূর্নাবয়ব কবিতার।
শিশুর কর্নে ধ্বনিকেন্দ্রিক দ্যোতনা এবং শব্দের মিল একটি আকর্ষনের সূচনা করে। কবিতা হয় তার আগামী জীবনের যোগাযোগের মূলসূত্র। অজানিতভারে শিশুর মনে র্সৃষ্টি হয় কবিতার প্রতি সহনশীলতা, আগ্রহ এবং এবং এই প্রক্রিয়ায় সাড়া দেবার জন্য একাত্মবোধ। অবচেতন মনে কবিতার প্রতি এই আগ্রহবোধ সুষ্টি কেবলমাত্র আমাদের দেশেই নয়, পুথিবীর সর্বত্রই এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটে। ঘুমপাড়ানি গান, ভিন্নদেশের লুলাবাই শ্রবনের পর্ব শেষ হলে শিশু যখন উচ্চতর বয়োসীমায় প্রবেশ করে, তখন বালক-বালিকাদের ছড়াপাঠ, ছোটদের কবিতা আবৃত্তি তাদের গুরুজন লালিত পরিমন্ডলে হয় মেধা-আশ্রিত উকর্ষতার পরিচায়ক। এসব উৎসাহ-উদ্দীপক উপস্থাপন বিদ্যাপীঠের অনুষ্ঠানে নয়, নিজগৃহে, আত্মীয়-পরিমন্ডলে গর্বিতা মাতা পুত্র-কন্যাকে উপহার দিতে বলেন সদ্য অনুশীলিত ছড়া বা কবিতাটি। প্রসংশিত তনয় বা তনয়ার মনের গহীনে কবিতার প্রতি আন্তরিক আগ্রহের সূচনা করেন পিতামাতা।   বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যান্য কর্মকান্ডের আধিক্যে, আপাত:ভ্রম হতে পারে যে কবিতা বুঝি অপসৃয়মান। বুঝি বিদ্যার্জনের প্রভূত প্রচাপ কবিতাকে শিক্ষাগত পাঠ এবং অনুধাবনের মধ্যে সীমিত করে রাখে। এদের মধ্যে ব্যতিক্রম, ভবিষ্যতের কবিবৃন্দ যারা বিদ্যাভাসের পাশাপাশি সংগোপনে কবিতার আরাধনা অব্যহত রাখে।
 পাশ্চাত্যের জনৈক প্রখ্যাত কবি কবিতার সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে বলেছিলেন.-”চড়বঃৎু রং ঃযব ংঁঢ়ৎবসব ভড়ৎস ড়ভ বসড়ঃরাব ষধহমঁধমব”। তদর্থে কবিতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম আবেগপ্রত’ত ভাষা। আবেগ বা তীব্রানুভূতির প্রাবল্য ঘটলে, যৌবনে দয়িতাকে নিয়ে নিয়ে কবিতা রচনা করেন নি বা কবিতার চতুর ব্যবহার করেন নি এমত প্রেমিকের সংখ্যা বিরল। বাংলাদেশের পরিবেশে মহাবিদ্যালয়ের সহপাঠিনী  অথবা প্রতিবেশিনীর কাছে প্রেরিত লিপিখানি উল্লিখিত সংজ্ঞা অনুযায়ী কবিতা বলে গৃহীত হতে পারে। বিশেষ করে যখন আধুনিক বাংলা কবিতায় গদ্যকবিতার প্রবাহ চলমান।
  অন্য এক প্রখ্যাত কবি বলেছিলেন,- কবিতায় তিনটি গুন অবশ্যই বর্তমান থাকতে হবে। এই তিনটি গুন হচ্ছে,- “গবষড়ঢ়রধ, ঢ়যড়হড়ঢ়রধ, ষড়মড়ঢ়রধ,-ঃড় পযধহঃ, ঃড় ংরহম ধহফ ঃড় ংঢ়বধশ”। কবিতায় থাকতে হবে, মন্ত্রিক তন্ময়তা, সংগীতের মন্ময়তা এবং একটি বক্তব্য বা বাণী। এই সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার অবদান আরো সুসংবদ্ধ এবং সুললিত হওয়া অপরিহার্য্য। বাংলাসাহিত্যের ইতিত্তৃত্তে প্রাচীন কবিতাবলীতে এই ধারনাবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ কবিই তাদের রচনাশৈলীতে এই ত্রয়ী গুনগত বৈশিষ্টের ব্যবহারে ক্রিয়াশীর ছিলেন। বলা যেতে পারে এই ধারা মোটামুটিভাবে বাংলা সাহিত্যের কবিতায়  বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশক পর্য্যন্ত বহমান ছিলো।

   চল্লিশ দশকের পরবর্তীকালে, বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে কবিতায় এসেছে একটি মহা পরিবর্তন। পূর্বে ছন্দ ও মিলের নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে বক্তব্য বা বাণীকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হোতো। প্রাচীনকালে শ্লোক, দোহা ও মূলস্রোতের কবিতার মধ্যে কবির উপস্থাপনার মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন বাণী সতত সমুপস্থিত ছিলো। ভগবত প্রেম, প্রকৃতি বন্দনা, ধর্মীয় অনুশাসন বা সামাজিক ক্রিয়াকর্মের নৈতিক বিধিমালা পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছে দেবার দায়দায়িত্ব ছিলো যুগোপযোগী । পয়ার, মাত্রা ও ছন্দের মোহনীয় আচ্ছাদনে আবৃত কবিতা পাঠত-পাঠিকাতে প্রভাবিত করে বলে শাসক বা রাজ দরবারে নিয়োগপ্রাপ্ত কবির দায়িত্ব শুধুমাত্র নৃপতিকে আনন্দ দান নয়, তার অলিখিত দায়িত্ব ছিলো জনসাধারনকে প্রভাবিত করাও।

    প্রাক কল্লোল যুগে এবং বাংলা সাহিত্যের মহাধিপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যে আছে বিশ্বপ্রেম, সৌন্দর্য্যবোধ, মানবপ্রেম ও সার্বজনীনতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা কবিতায় এলো মহা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ কবিতায় দেবত্ব-বন্দনার বদলে এলো সাধারন মানবতার কথা। কবিতায় রচিত হোলো অত্যাচারিত নির্য্যাতিত মানুষের কথা, তদসংগে তাদের সংগ্রামের কথা। বলা যেতে পারে, এ ব্যাপারে বাংলা কবিদের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অবশ্য তার ব্যপ্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বহু পর পর্য্যন্ত বিস্তারিত হলেও, তার সূচনা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেই। যে জনসাধারন একদা নতমুখে ললাটঙ্ক লিখন বলে ভাগ্যকে মেনে নিয়ে ঈশ্বর ও শাসকগোষ্ঠির সকল নির্দেশ গ্রহণ করতেন, বিদ্রোহী ক্িব কাজী নজরুল ইসলাম তাদের হাতে বিদ্রোহের বজ্রপতাকা তুলে দিলেন। যে কবিতা ছিলো কাব্যরসিকের একান্ত রসাস্বাদনের উপপাদ্য, তা সহসা এই নব্যধারার কবিদের বদৌলতে জনসাধারনের হাতে হয়ে উঠলো যে কোনো অন্যাযের বিরুদ্ধে উদ্যত হাতিয়ার। বিদ্রোহী কবির অগ্নিবীনার সুরে উজ্জীবিত অবিভক্ত ভারতবর্ষের আপমর জনসাধারন শিখলো জীবনের নব মূল্যায়ন। একার্থে বলা যেতে পারে কবিতা কেতাবী উচ্চাসন থেকে নেমে  এলো পদাতিক জনতার কাছে। কবিতায় এলো রাজনীতির ব্যবহার।
    কবিতায় ব্যবহারিক আটপৌরেতার কারনে তার মধ্যে কায়িক পরিবর্তনও ঘটলো প্রভূত। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, পয়ার ও ছন্দের আগল ভংগ করে শুরু হোলো সাধারন মানুষের কথিত ভাষার অনুরূপ ভাষা ও বাক্য প্রয়োগে কবিতা রচনা। কবিতা হোলো আরো বলিষ্ঠ, গদ্যময় ও জনপন্থী।  এদের মধ্যে অন্যতম ব্যতিক্রম, কবি মোহিতলাল মজুমদার। অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক কবির কবিতা গদ্যময় হলেও, বাক-প্রতিমা, চিত্রকল্প এবং উচ্চমার্গ শব্দের ব্যবহারবলী তার জন্য বাংলাসাহিত্যে একটি আলাদা স্থান নিশ্চিত করেছে।
    কল্লোল যুগ আমাদেন বাংলা কবিতা প্রসংগে একটি বিস্ময়কর অধ্যায়। কল্লোল যুগের কবিবৃন্দ অনন্য জীবনবোধের দহনে নিয়ত জ্বলেছেন। আর সেই অগ্নিশুদ্ধ বোধেউচ্চারিত পঙক্তিমালায় সজ্জিত করেছেন কাব্যের মানসীকে। অনাদিকালের মানব-মানবীর প্রেমকথা যেমন নতুনতর বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞায় বিবৃত হযেছে তাদের কবিতায় আবার তেমনি বিংশ শতকের হতদরিদ্র মানুষের আশা-আকাঙ্খা এবং আশাভংগের নিদারুন যন্ত্রনার ইতিকথাও বিধৃত হয়েছে তাদের কাব্যে। চন্দ্রসুধা পানের পাশাপাশি ক্ষুধার্ত কবি চাঁদকে একটি পোড়া ঝলসানো রুটি হিসাবে উপস্থাপিত করতে মোটেও কুন্ঠিত নন। সুকান্ত ভট্টচার্য্যরে এই জীবন-দর্শনের সমান্তরালে জীবনান্দ দাশ রোমান্টিসিজমের নীবিড় আলিংগনে বরন করেছেন প্রকুতিকে। সূর্য্যসম রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিকে প্রায় পাশ কাটিয়ে এইসব কবিরা বাংলা সাহিত্যে নিয়ে  এলেন কবিতার ভিন্নধারার ভিন্নমাত্রিক ঐশ্বর্য্য।
    কবিতা সার্বজনীন হলেও, কবিতাকে ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে সমুপস্থিত করার প্রচেষ্টা করা হযেছে। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর অবিভক্ত বংগদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে,- উপনিবেশবাদী সামগ্রিক পাকিস্তান সৃষ্টির অনতিবিলম্বে বাংলাসাহিত্যকে ধর্মের আলখাল্লা পরানোর প্রয়াস ছিলো প্রকট। ধর্মীয় বৈষমকে বৃহৎ করে প্রদর্শন করা ও  ভিন্নতর আত্মপরিচয় উদ্ভাবনের জন্য অত্যাগ্রহী পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির বদান্যতায় বাংলা কবিতায় ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবিদের অভিযাত্রা শুরু হয়। কট্টর আপাতঃধর্মবাদী শাসকগোষ্ঠির অনুপ্রেরনায় ফররুখ আহমদের সমসাময়িক এবং অনুসারী বেশ কিছু কবির আবির্ভাব ঘটে। ফররুখ আহমেদের কবিতায় চয়িত বাকপ্রতিমার ব্যবহার, চিত্রকল্প ও ছন্দের সমাহার তার কবিতাকে রসোতীর্ন ও কালজয়ী করলেও তার ভাবধারায় অনুপ্রানিত অন্য কবিদের কবিতা অপকবিতার নামান্তর মাত্র।
    কবিতার নানাবিধ ভূমিকা আছে। কবিতার নন্দনতত্ত্ব ও চেতনাকে অন্যরূপে উপস্থাপিত করে কবিতার আবেদনকে কবিরা বহুসময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করেছেন। যেহেতু অনেকসময় এই ব্যবহার মহত্তর কারনের জন্য, এই প্রক্রিয়ার ব্যবহার শুভ, সফল এবং কালোপযোগী। উনিশশো আটচল্লিশ সালে নবসৃষ্ট পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার কার্জন হলে বাংলাভাষার অধিকারগত ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে জনৈক মোহাম্মদ আলী জিন্নার কটূক্তি অজাত বাংলাদেশীদের জন্য একটি নতুন জাতীয়তাবোধের সূচনা করে। এই জাতীয়তাবোধের প্রয়োজন ছিলো জনসংযোগের জন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য বাহন। কবিতার চাইতে শ্রেয়তর বাহন আর কি হতে পারে?

    উনিশশো বাহান্ন সালের একুশে ফেব্র“য়ারীর শোনিতপাতে অভ্যুত্থান ঘটলো স্বাধীনতাকামী পূর্ববংগবাসীদের জাতীয় চেতনাবোধের অভিজ্ঞানের। বৈদুর্য্যরে মনি এই অভিজ্ঞানের আলোক সর্বস্তরে পৌঁছে দেবার জন্য পূর্ব বাংলার বাংলা সাহিত্যে ঘটলো কবিতার গন-বিপ্লব।
    একুশে ফেব্র“য়ারীকে কেন্দ্র করে এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গনমানসের জন্য উদ্দীপনামূলক যত কবিতা রচিত হয়েছে, দেশ বা জাতিগত গনসংগ্রামের জন্য পৃথিবীর অন্য কোথাও রচিত হয়েছে বলে জানা নেই। উপস্থিত গনচেতনাকে সংঘবদ্ধ করার জন্য, আন্দোলনের জন্য সমগ্র বাংগালী সত্ত্বাকে একত্রীভূত করার জন্য জাতীয়তাবোধের নতুন আলোকে উদ্ভাসিত বাংলাদেশের কবিরা সৃষ্টি করেছেন অনন্য কবিতাসমূহ।
    এই কাব্যকাল, ঈষৎ দ্বিধার সংগে মন্তব্য করা যেতে পারে, বাংলাদেশের কবিদের একাগ্র্রমন্যতা প্রেম-ভালোবাসা, বিশ্বপ্রেম, নৈসর্গিক দুশ্যাবলী, সার্বজনীনতা ইত্যাদি,- কবিতার প্রচরিত বিচরন ক্ষেত্র থেকে ব্যবধানের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বাংলা কবিতার এই কালটি ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কাব্যকাল। শক্তিশালী উদ্দীপ্ত কবিদের লেখনীতে রচিত হয়েছে ভাষা ও স্বাধীনতা-কেন্দ্রিক অমর কবিতাসমূহ। কিন্তু একমুখী এই কাব্যরচনার ধারার গড্ডালিকাপ্রবাহে তাড়িত কিছু লালিত্যবিহীন শ্লোগানজাত অধোকবি ও অধোকবিতার সৃৃষ্টি করে।
    এই প্রসংগে আর একটি ব্যাপার গভীর দুঃখের সংগে অনুধাবন করা হয়েছৈ। একুশে ফেব্র“য়ারী ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক যেসব মহার্ঘ অনুপম কবিতাবলী রচিত হয়েছে, সেগুলি পুথিবীর অন্য প্রধান ভাষাগুলিতে অনুদিত না হওয়ায়, বিশ্বসাহিত্যে এগুলি যথার্থ উচ্চ সম্মান লাভ করতে সক্ষম হয় নি। কেবলমাত্র কাব্যশৈলীর মানদন্ডেও কবিতাসমূহ আন্তর্জাতিক সাহিত্যে মূল্যায়িত হতে পারতো। এইসব কবিতাসমূহ পৃথিবীর যে কোনো দেশে স্বাধীনতাকামী , স্বাধীকারের প্রচেষ্টায় লিপ্ত মানবের উদ্দীপনার সঞ্জীবনী মস্ত্র হতে পারতো।
    পশ্চিম বংগের কবিরা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের এই মহাঅন্দোলনের সংগে সম্যকভাবে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তারা নীবিড়ভাবে এই সাহিত্য-বিপ্লবকে অবলোকন করেছেন। তারা আন্তরিকভাবে এবং সংর্স্কৃতি ও চেতনাগত সাহিত্য-বন্ধনের জন্য বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের প্রতি সংবেদন ও সহানুভূতিশীল। পশ্চিম বংগের সমসাময়িক বাংলা কবিতায় এর প্রতিফলন বর্তমান।
    বলাবাহুল্য, পশ্চিম বংগের কবিতার ধারা ভিন্নতর। তাদের কবিতার ধারায় বিশ্ব-সাহিত্যের সংগে স¤পৃক্ততা বেশী। বিশ্বায়নের যুগে কবিতা তথা সাহিত্য হচ্ছে মনোসংযোগের একমাত্র বুদ্ধি-মাধ্যম। এই বুদ্ধি-মাধ্যম এবং এর ব্যবহারকারী সাহিত্য-জনপদ কোনো ভৌহলিক বা সামাজিক দুরত্বকে গ্রাহ্য করে না। পশ্চিম বাংলার বাংলা কবিতা রচয়িতাদের দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের মহাসম্মেলনে অন্যদেশের কবিদের নৈকট্য। কিন্তু বাংলাদেশের কবিদের দিয়েছে স্বাতন্ত্রের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট।   
    ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালের কালে, রাষ্ট্রীয় স্থিতিলাভের পরে বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় পালে লেগেছে নতুন পবনের ছোঁয়া। বাংলা কবিতা নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে। আত্মপ্রত্যয়ী কবিরা কবিতা নিয়ে, এর আংগিক, বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনা নিয়ে অধুনা পরীক্ষা-নীরিক্ষায় লিপ্ত। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী কবিরা সাফল্য অর্জনের পর আবার নববেশে কাব্যমানসীর দুয়ারে নবসম্ভারে উপনীত।

    তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির জনসাধারন ও বুদ্ধিমত্তা নীতিগতবাবে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী। পশ্চিমা শক্তিজোটের বহু বৎসরের প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ শোষন এই দেশসমূহের কবিদের অবচেতন সত্ত্বায় সুষ্টি করেছে প্রতিবাদের পরিভাষা। এই পরিভাসা রূপান্তরিত হয়েছে তাদের রচনায়। পূর্বসূরী নাজিম হিকমত, সুকান্ত ভট্টচার্য্য, ইয়েভতুশেংকো, ফেদরিকো গথিয়া লোরকা ইত্যাদির ভাবধারার অনুসারী, সত্তুর আশির দশকে বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় আগমন ঘটেছে একঝাঁক বুদ্ধিদীপ্ত অতীব প্রাণবন্ত কবির। তাদের কবিতা শ্লোগান নয়, কিন্তু বক্তব্য এমনই সাবলীলতায় উচ্চারিত যে তা অবশ্যই অনুপ্রনিত পাঠক-পাঠিকার মরমে পৌঁছে। তাদের কবিতা মন্ময়তা আর তন্ময়তার আধারে হয়েছে আরো কাব্যাশ্রয়ী। গদ্য বর্তমানে কবিতার মূল বাহন হলেও, ছন্দ ও মিলের ব্যাপারে কোনো দায়বদ্ধতা না থাকলেও কাব্য রসিকরা পরমোৎসাহে অনুধাবন করছেন, বাংলা কবিতায় একটা বিবর্তন চলছে। এখন অনেকে আবার স্বছন্দে স-ছন্দ সমিল কবিতা রচণা করছেন। মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, পয়ার এবং আন্তিক মিলের পূর্ণবাসন ঘটছে ঠিকই, কিন্তু লক্ষনীয় যে বাক-প্রতিমা, উপম্াবলী, চিত্রকল্প, বাক্যশৈলী অত্যাধুনিক ও অতি সা¤প্রতিক। যারা গদ্য কবিতা লিখছেন, তাদের রচনায় মিলের অনুপস্তিতি ব্যতিরেকে কবিতার অন্যান্র গুনাবলী বিদ্রমান ও সমুজ্জ্বল।

    পৃথিবী এখন একটি বৃহৎ গ্রাম ছাড়া আর কিছু নয়। পৃথিবীর যেখানে অক্ষরেখা মিশেছে দ্রাঘিমার সাথে, তা সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, সেখানে সন্দর্শন পাওয়া যাবে একজন বাংলাদেশীর বা বাংগালীর। জীবনের তাড়নায়, জীবিকার অšে¦ষনে বাংলাদেশের মানুষ আজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। আমেরিকার প্রত্যন্ত শহরে, সৌদি আরব, দুবাইয়ের কলকারখানায়. কানাডা, যুক্তরাজ্যের অলিতে গলিতে বাংলাদেশীদের অধিবাস। প্রবাসে বসতি স্থাপনের সাথে সাথে তারা সংগে বহন করে নিয়ে এসেছেন তাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এনেছেন তাদের অন্তরংগ সম্পদ, বাংলা কবিতা। বাংলাদেশীর ধমনীতে বহমান কবিতা। কবিতার সংগে তার যে পরিচয় মাতৃক্রোড়ে। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমার উচ্ছ্বলিত জলরাশি, সোনালী ধানের ক্ষেত, চট্টলার উতুংগু পর্বতমালা, বেন নেভিস, টেমস নদীর পারের প্রবাসী বাংরাদেশীদের মনে ঢেউ খেলিয়ে যায়। কর্মক্লান্ত জীবনের অবসরে প্রবাসী বাংলাদেশী আত্মমগ্ন আপন দেশের শিল্প-সাহিত্য চর্চায়। প্রবাসে আত্মসমাহিত কবি রচনা করছেন বাংলা কবিতা।                                

    বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশীদের অধিবাস বৃহত্তম। তার ফলে যুক্তরাজ্যে গঠিত হয়েছে একটি শক্তিশালী বাংলা সাহিত্য-গোষ্ঠি। বাংলাদেশের বাইরে বাংলা সাহিত্যের এই অবয়ব বাংলাদেশের সাহিত্য ও কবিতার অবয়ব থেকে ভিন্নতর। যুক্তরাজ্য কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য এর ব্যতিক্রম নয়।

    যুক্তরাজ্যের বাংলা কবিতার কতিপয় গুনগত লক্ষণ আছে। এইসব গুনগত ব্যতিক্রমী লক্ষণগুলির কারণ হচ্ছে ভিন্ন পারিপার্শ্বিকতা এবং প্রবাস-মানসিকতা। প্রবাসী কবি সাহিত্যিকবৃন্দ বাংলাদেশের মূল ধারার সাহিত্যের সংগে একাত্মবোধ করলেও, তারা দূর থেকে বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্রের ক্রমপরিবর্তনকে আরো গভীরভাবে, বিশেক্ষষনের দুষ্টিক্ষেপে অবলোকন করতে পারেন। বাংলাদেশে আপাতঃ বাক-স্বাধীনতা থাকলেও দেশের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের জন্য বহু রচনা প্রয়াস বিঘিœত বা নিষিদ্ধ প্রায়। যুক্তরাজ্যের কবিরা বাস করেন একটি গনতান্ত্রিক দেশে যেখানে বাক-স্বাধীনতা স্বাধীকারের মহিমায় সুপ্র্রতিষ্ঠিত। ফলে বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্যে যে রচনা অবদমিত ও নিষিদ্ধ-প্রায়, এ দেশের কবি সাগিত্যিকরা তা অনায়াসে ব্যক্ত করছেন। তাদের এই উচ্চকণ্ঠ রচনামালা, বলা যেতে পারে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের নৈতিকভাবে মানসিক ও সাহসের পরিপোষক।

    সাহিত্য এবং সাহিত্য-আন্দোলন,- এ দু’টি  একেবারেই আলাদা জিনিষ। যুক্তরাজ্যে একটি দ্রুত, ধাবমান ও পরিবর্তনশীল সাহিত্য আন্দোলন শুরু হয়েছিলো আশির দশকে। সেই সময়ের বেশ কিছু ভারী তরুন কবি, যারা এখন প্রৌঢ় প্রায়, কবিতা রচনায় অভূতপূর্ব চমকের সৃষ্টি করেছিলেন। বিশ্বসাহিত্যের সংগে সম তালে কবিতার আংগিক, ছন্দ ও উপস্থাপনা নিয়ে রীতিমত পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। প্রচন্ড জীবনবোধ, দেশপ্রেমের অমিয়ধারা এবং প্রবাসী জীবনযাত্রার মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি তাদের কবিতায় সংযোজন করেছিলো উচ্চতর মাত্রা। বিস্মযকর ব্যাপার এ্ই যে, এইসব কবির অনেকের জন্ম এবং লালন-পালন এইদেশ্।ে এতদসত্ত্বেও তাদের মননশীর সাহিত্যচেতনা বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যকে আশ্রয় করে ধৃত হয়েছে।

    এই মন্তব্য একটি ভ্রম হতে পারে,- অধুনা যুক্তরাজ্যের সাহিত্য আন্দোলন স্তিমিত। বলাবাহুল্য, আন্দোলন স্তিমিত, কিন্তু সাহিত্য বা কবিতা রচনা নয়। বহু কবি নীরবে একান্তে নিরলস কাব্য-সাধনা করে যাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যে বাংলা কবি-সাহিত্যিকের কমতি না থাকলেও বাংলা প্রকাশনার অবস্থা অতীব শোচনীয়। ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত প্রচেষ্টায় কিছু কিছু প্রকাশনা ঘটছে বৈকি। কিন্তু বানিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থার অভাবে যুক্তরাজ্যের কবিদের অমূল্য রচনাসম্ভার যুক্তরাজ্যের বাংগালী পাঠক-পাঠিকার কাছে এবং বাংলাদেশের সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। ফলে, গভীর দুঃখের সংগে বলা যেতে পারে, বাংলা সাহিত্যের উচ্চমানের এইসব রচনা-সম্ভার থেকে কাব্যরসিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কি আশ্চর্য্য র্বাপার, প্রাপ্তিযোগের কোনো সম্ভাবনা নেই জেনেও নিবেদিত প্রাণ প্রবাসী কবি-সাহিত্যিরা একাগ্রমন্য সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত আছেন।

    যুক্তরাজ্যের বহু সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর অনেক প্রধান ভাষাগুলির সাহিত্য-চর্চা স্তিমিত। সেক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী সাহিত্য সংগঠন ও সংযোজন প্রভূত। তাদের এই সাহিত্য সাধনা মহার্ঘ। বাংলাদেশের জাতীয়তাবোধের চেতনায় নিয়ত উদ্বুদ্ধ, ভাষা সংগ্রামের অধিকার অর্জনের প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত এই প্রজন্মের কবিরা, যাদের একুশে ফেব্র“য়ারীর সংগে কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই, বাংলাদেশের সংগে কায়িক পরিচয় স্বাল্পিক অবসরের সীমাবদ্ধতায়, তারা কি অমিত জীবনবোধে সম্পৃক্ত হযে বলছেন বাংলাদেশের শ্যামল রঙ রমনীর কথা। বিলাতের অগোছালা কক্ষে বসে রচনা করছেন বাংলাদেশের চাপা পড়া মানুষের ইতিকথা। তাদের কবিতা চিত্রপটে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানব-মানবী অপরূপ বর্নচ্ছটায় সমুপস্থিত।

    কবিতা, যার সংগে আমাদের আঁতাত শুরু জন্মলগ্নে, দেশ ও সময়ের ব্যবধান, জীবন ও জীবিকার ক্রমবর্ধমান তাগিদ, সব কিছুকে উপেক্ষা করে, সে আমাদের মনের মাঝারে মরমে মরমিয়া হয়ে আমাদের সংগেই আছে।

    কবিতা যে আমাদের আমৃত্যু জন্মসহচরী।